

পাবনা, সাঁথিয়া
মাওলানা শামীম আহমেদ:—-
সাংবাদিক ইসলামিক কলামিস্ট।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বিশ্বনন্দিত ইসলামী আন্দোলনের নেতা ছিলেন । তিনি ১৯৪৩ সালের পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমতপুর গ্রামে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও মেধাবী ছিলেন।ছাত্র জীবনে তিনি ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কাজ করেছেন।ছাত্র জীবন শেষ করে তিনি এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তার অগ্রণী ভূমিকা যুগ যুগ ধরে মানুষ স্মরণ করবে। পিছিয়েপড়া ইসলামী শিক্ষাকে জেনেরেল শিক্ষার সমমানের আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলনসহ গণমানুষের বিভিন্ন আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। এ কারণে নানা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মাওলানা নিজামী। জীবননাশের চেষ্টাও করা হয়েছিল বহুবার।
২০১০ সালের ২৯ জুন কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত মামলায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠান থেকে বের হওয়ার পথে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পর একের পর এক মিথ্যা ও সাজানো মামলায় দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় তাকে । মাওলানা নিজামীকে মোট হয়রানিমূলক ১১টি মামলায় জড়ানো হয়েছিল। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, রাজধানীর পল্টন থানায় ৩টি মামলা, রমনা থানায় ১টি মামলা, উত্তরা থানায় ১টি, কদমতলী থানায় ১টি, রাজশাহীর ফারুক হত্যা মামলা, কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া মামলা, পল্লবী ও কেরানীগঞ্জে একটি করে মামলা দেখানো হয়। এর মধ্যে পল্লবী ও কেরানীগঞ্জ থানায় দায়ের করা দু’টি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। চারদলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ এই নেতাকে এসব মামলায় কয়েকবার রিমান্ডে নেয়া হয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের আদেশে ধানমন্ডির কথিত সেফহোমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১২ সালের ২৮ মে চার্জ গঠন করা হয়। ওই দিন তিনি এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামী করার অপরাধেই আমার বিরুদ্ধে এসব সাজানো অভিযোগ আনা হয়েছে।
সরকার কর্তৃক সাজানো মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের কারণে মাওলানা নিজামীর নির্বাচনী এলাকা পাবনার (সাঁথিয়া ও বেড়া) উপজেলার জনগণ ছিল ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। এলাকার জনগণ ও কিছু মূক্তিযোদ্ধাকে বলতে শুনেছি, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো সময়টাতেই তাকে এলাকায় দেখা যায়নি। তার দ্বারা এ সময় কোন অপরাধমূলক কাজ করার প্রশ্নই আসেনা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই মাওলানা নিজামীকে জড়ানো হয়েছে ঐসব মিথ্যা মামলায়।”
মাওলানা নিজামী ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে কৃষিমন্ত্রী পরে শিল্পমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। দু’টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করার পরেও তার বিরুদ্ধে কেউ একটি পয়সার দুর্নীতির অভিযাোগও প্রমাণ করতে পারেননী। তিনি নির্মহ একজন সাৎমানুষ ছিলেন। প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই পিছিয়ে পড়া জনপদ সাঁথিয়া-বেড়ার উন্নয়নে হাত দেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়াই শিক্ষাসহ সাঁথিয়া-বেড়ায় অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়।
বিগত আ’লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছে। এই বিচারের জন্য প্রণীত আইন ও বিধিমালা নিয়ে দেশে বিদেশে আপত্তি ছিল। এর স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ, আইনজীবীদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা এ নিয়ে নানা সুপারিশও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিগত সরকার তাতে কোন কর্ণপাতই করেনি, বরং সৈরাচার আ’লীগ সরকার কখনও বলছে, এটা দেশীয় ট্রাইব্যুনাল, আবার কখনও বলেছে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আবার কখনও বলেছে, আন্তর্জাতিক মানের দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। আর আইনজ্ঞগণ স্পষ্টই বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল না দেশীয় মান ছিল, আর না আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং এর দ্বারা একজন নাগরিকের সামান্য অধিকার সংরক্ষণও সম্ভব নয়।
ইতিহাস বলে ,যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, নির্যাতন হয়েছে, নিপীড়ন হয়েছে নানাভাবে, নানা কৌশলে। বারবার থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে। কিন্তু কোন দমন নিপীড়নই ইসলামী আন্দোলনের পথচলা থামিয়ে দিতে পারেনি, পারবেও না ইনশাআল্লাহ। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শুধুমাত্র একজন ইসলামী ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, এদেশের তৌহিদী জনতার কণ্ঠস্বর, গণমানুষের নেতা, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা। যিনি গভীর দেশপ্রেম, পরিচ্ছন্ন চিন্তা এবং সততার সাথে আজীবন বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য তাঁর সকল প্রয়াসকে অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শুধু মিথ্যাই নয় বরং এযুগের শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার ।২০১৬ সালের ১১ মে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার এই মহান ইসলামী ব্যক্তিকে অন্যায় অবৈধভাবে যুদ্ধাঅপরাধের দায়ে ফাঁসি দেন।
বাতিল শক্তি ও মিথ্যাচারের কাছে মাথা নত না করে ফাঁসির দড়িকেই ফুলের মালা হিসেবে বরণকরে নিয়েছেন শহীদ মাওঃমতিউর রহমান নিজামী । জনগণ বিশ্বাস করে, সকল মিথ্যাচারের অবসান ঘটিয়ে একদিন এ দেশে ইসলামের বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ। আমিন।